ইরানে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার আগমন হয়েছি যেভাবে। ২৬ জুন ২০২৫

ইরানে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার আগমন হয়েছি যেভাবে।

মানবজাতির ইতিহাসে কিছু পরিবর্তন এমনভাবে ঘটে, যা কেবল ভৌগোলিক মানচিত্র নয়, বরং সংস্কৃতি, চিন্তাধারা ও সমাজব্যবস্থার মৌলিক ভিতকেও পাল্টে দেয়। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ইরানে ইসলামের বিজয়।

ইসলাম বিজয়ের আগে ইরান ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের অধীন। ইসলাম বিজয়ের পূর্ববর্তী সময়ে তা ভয়াবহ অবিচার, শ্রেণিবৈষম্য, দুর্নীতি ও নির্যাতনের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল।

ধর্ম হিসেবে জরথুস্ত্র মতবাদ ছিল সরকারিভাবে স্বীকৃত, কিন্তু সাধারণ জনগণ সেই ধর্মীয় কাঠামো থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

এরই মধ্যে খলিফা আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে, সাহাবি মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.)-এর নেতৃত্বে ইরানে ইসলাম বিজয়ের প্রথম ধাপ সূচিত হয়।

তিনি সাওয়াদ অঞ্চলের আশপাশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমি জয় করে ইসলামী পতাকা উড্ডীন করেন, যা ছিল এক বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা। খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে ইরানে ইসলামী বিজয় নতুন গতি পায়।

সাহাবি আবু উবাইদ আস-সাকাফি (রা.) ১৩ হিজরিতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে পারস্যে অভিযান শুরু করেন। তিনি সেতুর যুদ্ধে পারস্য সেনাপতি জাবানকে পরাজিত ও বন্দি করেন।

এরপর কাসকারে নরসির এবং গ্যালেনের সঙ্গেও সফলভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তবে এক পর্যায়ে পারস্য বাহিনীর আকস্মিক হামলায় মুসলিম বাহিনী চাপে পড়ে।

অনেক সৈন্য নিহত ও পানিতে ডুবে যায়, আর এই যুদ্ধেই শহীদ হন আবু উবাইদ আস-সাকাফি (রা.)।

(সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪২১)
১৪ হিজরিতে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ইরান বিজয়ের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অতিক্রম করে।

ঐতিহাসিক আল-কাদিসিয়া যুদ্ধে পারস্য বাহিনী মুসলমানদের কাছে নির্মমভাবে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের অন্যতম বড় বিজয়, যা ইরানে ইসলামী শাসনের পথ সুগম করে।

ঐতিহাসিকদের মতে, কাদিসিয়া যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় আট হাজার, আর পারস্য সেনাপতি রুস্তুম নেতৃত্ব দেন প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের।

১৪ হিজরির মহররম মাসের এক সোমবার প্রবল ঝড়ে পারস্য বাহিনীর তাঁবু উড়ে যায়, এমনকি রুস্তুমের বিছানাও ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে।

তিনি পালাতে চেষ্টা করলে মুসলিমরা তাঁকে ধরে হত্যা করে। পারস্য বাহিনীর আরেক নেতা আল-জালানুসও নিহত হন।

এই যুদ্ধে মুসলমানরা পারস্যদের পরাজিত করে। উপর্যুপরি হামলায় তাদের ৩০ হাজার সদস্য নিহত হয়। আর কয়েক দিনে দুই হাজার ৫০০ মুসলিম শহীদ হন।

এরপর মুসলমানরা পরাজিত পারস্য সেনাদের ধাওয়া করতে করতে মাদায়েন শহরে প্রবেশ করে, যা ছিল পারস্য বাদশাহর রাজধানী এবং খোসরোর প্রাসাদ ‘ইওয়ান’-এর অবস্থান।

কাদিসিয়া যুদ্ধে মুসলিমরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র লাভ করার পর গনিমতের মাল একত্র করে ভাগ করা হয়,

যার এক-পঞ্চমাংশ খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কাছে সুসংবাদের সঙ্গে পাঠানো হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-৬৩০)

মুসলিমরা ইরানের ভূখণ্ডে তাদের বিজয়ের ধারা অব্যাহত রেখে দক্ষিণ ইরান দখল করে। ১৮ হিজরিতে জালুলার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী ও ইয়াজদেগার্দের সেনারা সম্মুখ সমরে লড়াই করেন,

যেটি ইয়াজদেগার্দ ও তার বাহিনীর পরাজয়ে শেষ হয় এবং তিনি ইসফাহানের দিকে পশ্চাদ গমন করেন।

আল্ল্লামা তাবারি (রহ.) লিখেছেন, সেদিন এক লাখ সৈন্য নিহত হয়, যাদের মৃতদেহ মাঠসহ তার আশপাশ সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছিল। এ কারণে ওই স্থানটির নাম হয় জালুলা। (তারিখুত তাবারি, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৬)

এরপর ২১ হিজরিতে নাহাওয়ান্দের চূড়ান্ত যুদ্ধে মুসলিমরা ইয়াজদেগার্দের পরাজিত করে এক মহা বিজয় অর্জন করে।

এর পর সাসানীয় শাসকরা আর কখনো পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। গনিমতের বিপুল সম্পদের কারণে এই যুদ্ধে মুসলিমরা ‘বিজয়ের বিজয়’ নামে সমাদৃত হয়।

ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন : ‘এই যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর। মুসলিমরা এটিকে বিজয়ের বিজয় বলে অভিহিত করেছিল।’ (আল-বিদায়া ওয়াল-নিহায়া, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-১১১)

দেশটির বিস্তৃতি ও দুর্গমতার কারণে পুরো ইরান নিয়ন্ত্রণে নিতে মুসলমানদের প্রায় এক দশক সময় লেগেছিল।

অতঃপর ইসলামের প্রচার-প্রসার সহজ হয় আরব গোত্রের অভিবাসন, বসতি স্থাপন ও ইরানিদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক মিশ্রণের মাধ্যমে।

৯০৬ হিজরিতে শিয়া সাফাভিরা ক্ষমতা গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত প্রায় ৯ শতাব্দী ধরে ইরান সুন্নি মতবাদ অনুসরণ করে আসছিল।

এটি শুধু সামরিক নয়, বরং এক ঐতিহাসিক বিপ্লব, যার মাধ্যমে ইরান ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও বিশ্বব্যবস্থায় স্থায়ী পরিবর্তন এনেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *